

গোলা-শিল্পের বিকাশে আজতক আহাজারি...
গোলা-গোয়াল-গৃহ’ শিরোনামটির মধ্যে সারকথা কী? কলামটি চালুর আগে বন্ধুবর সম্পাদক প্রশ্ন করেছিল। এক কথার জবাবে বলেছিলাম, কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। দেশের শতকরা ৮৬ ভাগ মানুষ কৃষিজ পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত। কৃষিপণ্যের সঙ্গে সম্পর্ক শতভাগ মানুষের। প্রবাসে গিয়ে দেখেছি দেশজ পণ্যের প্রতি কি ব্যাপক চাহিদা। অ্যামেরিকা-কানাডার প্রবাসীরা যেন দেশীয় শুটকিতেও বুঁদ। মহানগরী ঢাকা বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে এতো শুঁটকি খেতে দেখিনি। দেশীয় মাছ, চাল, মসলা, কাঁটা সব্জি, মুড়ি, চিড়া, মোয়া, নাড়–, ঝাড়–, সরিষার তেল, ঘি কী নেই রপ্তানি তালিকায়? অর্থাৎ বাংলাদেশের কৃষিজ পণ্য রপ্তানিতে প্রবাসও বিশেষ গুরুত্ববহ। অন্যদিকে প্রবাসীরাও দেশীয় পণ্যের মানের বিষয়ে সদা চিন্তিত।
‘গোলা-গোয়াল-গৃহ’ নামের আয়োজনে কৃষিজ পণ্য নিয়ে অনেক লিখেছি। বিদেশের অভিজ্ঞতা পাতে তুলে দেয়ার পরিকল্পনাও ঢের। পৃথিবীর যেখানেই থাকি-যেন চিন্তার মধ্যেই থাকে প্রসঙ্গটি। ‘গোলা-গোয়াল-গৃহ’ শিরোনামটি আসলে আমার হৃদয় উৎসারিত উচ্চারণ। আমার শৈশব-তারুণ্যের স্মৃতি ও উদ্দীপনার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে কৃষিপ্রধান পরিবারই সর্বাধিক। আমারও জন্ম এমন একটি ভূমি-নির্ভর পরিবারে। বাবার ব্যবসাও ছিলো। তবে আয় উপার্জন ছিলো ব্যবসা ও কৃষিভূমি মিলিয়ে ৫০:৫০। ফলে জমি কর্ষণ, চারা রোপণ, ফসল উৎপাদন থেকে গোলায় ভরা পর্যন্ত সকল পর্বের কাজ আমার জানা। শুধু কি জেনে রাখা? সম্পর্ক থাকতে হয়েছে কাদা-মাটির কৃষিজ কর্মপ্রবাহে। শিক্ষা জীবনের সঙ্গে কৃষি শিক্ষার বাস্তব সংযোগ দারুণ স্মৃতিপ্রদ। বিশাল সম্পদও।
কৃষিপ্রধান বাংলায় ‘গোলা’ বা গোলাঘর এক বহুমাত্রিক বাতিঘর। বছরের উপার্জিত পণ্য সংরক্ষণের আবহমান গুদাম। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত মানেই সংসারে গোলাঘরের আয়োজন। বাংলাদেশের কৃষিনির্ভর সুবিশাল অর্থনীতির সংরক্ষকও এই পারিবারিক আয়োজন। এ বিষয়ে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক (বর্তমানে অর্থ মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি) দিয়েছিলেন বহুমুখী বিশ্লেষণ। একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, গোলাঘর সংস্কৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বিশাল বিপ্লবের নাম। ঘরে ঘরে গোলা না থাকলে গ্রামে গ্রামে লাখ লাখ খাদ্য গুদাম বানাতে হতো। সরকারের পক্ষে একশত বছরেও এমন পণ্যাগার গড়া সম্ভব নয়। সুতরাং পরিবারে পরিবারে গোলাঘর সমৃদ্ধকরণের কাজকে অনুপ্রাণিত করা উচত।
প্রবাসের একটি সমৃদ্ধ কাগজের জন্যে ড. রাজ্জাক সাক্ষাৎকারটি দিয়েছিলেন। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে গোলাঘরকে গুরুত্ব দেয়া না দেয়া বিষয়ে প্রশ্ন করেছিলাম। প্রশ্নটির কারণ হলো ব্যাপকহারে চুরি। গ্রামীণ ডাকাত বা চোর সম্প্রদায় পেশাজীবনে সর্বাধিক টার্গেট করে গোলাঘরকে। প্রতিপত্তি অলা জোতদারেরা সাধারণত পাহারা বসায়। কুকুরও পোষে। ঘরে বন্দুকও থাকে। ফলে চুরি বা ডাকাতির অপারেশনে বড় ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু মধ্যবিত্ত পরিবারের গোলাঘর অনেকটা অরক্ষিত। কম সম্পদ, তাই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও কম। ফলে, খানিকটা ঝাঁকুনি মার্কা অপারেশন দিয়েই মালামাল খালাস। এক বিশাল অংকের কৃষিজ পণ্য চোর-ডাকাতের সম্পদে পরিণত হচ্ছে।
গ্রামজীবনে একদা নানান কৌশলে সম্পদ রক্ষার চেষ্টারত মানুষ দেখেছি। কিশোর-তরুণদের জাতীয় সংগঠন চাঁদের হাটের স্থানীয় শাখার কর্মকর্তা আমরা। অফিসঘর গড়তে বাঁশ সংগ্রহের লক্ষ্যে গিয়েছিলাম অধিকতর গ্রাম এলাকা সোনারায়ে। জোতদার ও দানশীল ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত জনাব পালানু সরকারের নিকট। প্রবীণ এই ব্যক্তির জমির পরিমাণ প্রায় তিনশ’ একর। বাঁশবাগানও অনেক। আমাদের নির্মাণাধীন ‘ক্লাবঘরের’ জন্যে একশ’ বাঁশের অনুদান দিলেন। সবি ঠিক আছে, তবে একটি বিষয়ে আমরা অবাক হলাম। ওনার বাড়িটির গঠনপ্রণালী দেখে। দু’তলা বাড়ি, কোনো নিচতলা নেই। সিঁড়িও নেই। অর্থাৎ সিঁড়িবিহীন কাঠের দু’তলা। বাড়িতে যথারীতি শোবার ঘর, রান্না ঘর, গোসলখানা, প্রসাধন বা প্রক্ষালন কক্ষ আছে। এমনকি বিশাল গোয়ালঘরও আছে, তবে সিঁড়ি নেই। নিচে খোলা বৈঠকখানায় বসে আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। চোখে মুখে ঠোঁটে অবাক বিস্ময়ে মেলে ধরলাম প্রশ্ন।
প্রবীণ পালানু চাচা হাসলেন। বললেন, ‘ঠকে ঠকে শিখেছিরে বাবা। এই গ্রামের মধ্যে থাকি। বাঘ-ভাল্লুকের চেয়েও বেশি সমস্যা করে চোর ডাকাইত। আগে তিনবার আমার গোলা, সিন্দুক লুট কইরছে। এখন আর পারে না, শূন্যের মাঝারে উঠাইছি বাড়ি-ঘর। কি বাবাজি সিঁড়ি খুঁজছেন? কোনোই সিঁড়ি নাই। আমরা দু’তলায় উঠি মই দিয়া। রাইতের বেলা মই তুলি নেই উপরে। তারপর দরোজা বন্ধ। আর চোর ডাকাইত আইসবে কোন পথে? সিঁধ কাটার সুযোগও নাই। বন্দুক আছে, ডাকাইত পড়িলে খবর আছে। বুঝলেন বাহে, হামার আর গোলা নিয়া ধান-চাউল ভুট্টা-সরিষা নিয়া টেনশন নাই। এখন টেনশন ধানক্ষেতে। চোরেরা এখন মাঠমুখী হইছে। রাতারাতি ধান, তামাক কাটি নিয়া যায়। তাই পাহারা বসাইতে হয় মাঠের মাইধ্যে।’
চার দশক চলে গেছে। শস্য মাঠের সুরক্ষা নিয়ে পরিস্থিতির তেমন পরিবর্তন হয়নি। মাঠ সুরক্ষার প্রসঙ্গ এলে আমি স্মৃতিকাতর হয়ে উঠি। সত্তরের দশকে ফসলের ধান সংরক্ষণে পাহারা বসাতে হতো। চিকনমাটি দোলা পাড়ার বিশাল ধানক্ষেত। একদিকে চলতে থাকে ধান কাটার মহোৎসব। আঁটি আঁটি করে তা গম্বুজ আকারে সাজানো হতো। এই ধান মাঠ থেকে গৃহস্থের আঙিনা পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লাগতো। ২ দিন, ৩ দিন, এমনকি ৭ দিনও। এর একাধিক কারণ ছিলো। প্রথমত একমাত্র পরিবহন ব্যবস্থা ধীরগতির গরুরগাড়ি। দ্বিতীয়ত সড়কের অপ্রতুলতা। ক্ষেতের ওপর দিয়ে আল কেটে বানানো হতো বিশেষ মেঠোপথ। ৮/১০ শরিকের জমি মাড়িয়ে তবেই বড় সড়কের ওপর ওঠা। সামনের জমিনের ধান কাটতে বিলম্ব হলে পেছনের জমি-ফসল-ব্যবস্থাপনাকে অপেক্ষা করতে হতো। এজন্যে অনেকের ফসল কম হলেও রাস্তার সুবিধার জন্যে অপেক্ষায় থাকতে হতো। তাঁবু পড়তো অপেক্ষাকৃত ভেতরের জমিগুলোতে। এগুলোতে রাত কাটানোর ব্যবস্থা থাকে। পাহারা নামক অলস সময় যাপনের সে এক অভিনব আয়োজন। জীবনে একাধিকবার এমন পাহারা কর্মের অভিজ্ঞতা নিয়েছি। টানা ৩/৪ দিন পাকা ধানের সঙ্গে থাকতে পারাটা এক প্রকার অ্যাডভেঞ্চারও। এমন তাঁবু সংসারকে বলা হয় ডেরা।
আমাদের ডেরা জীবনটি কিছুটা রোমান্টিকও ছিলো। চারদিকে ধান আর ধান। টর্চ লাইট, রেডিও, বল্লম, তীর-ধনুক রাতের সঙ্গী। চোর-ডাকাত তাড়ানোর রাতগুলো সকাল হতো নতুন স্বপ্ন ছড়িয়ে। একাধিক তরুণী আসতো ডালাতে ভাঁপা পিঠা আর পাটালি গুড় নিয়ে। আঁটিঅলা কাঁচা ধানের বিনিময়ে গরম পিঠা। কারও কারও ডালিতে চায়ের কেটলিও থাকতো। খাতির জমাতে পারলে ছিপিঅলা কৌটায় ডাবের পানিও আসতো।
দূরের সুপুরি গাছঅলা পাড়া থেকে নেমে আসতো এই নবসুন্দরী চক্র। এদের কেউ কেউ স্কুলে বা মহিলা মাদ্রাসায় যায়। সকাল ১১টার পর সেই অধ্যয়ন পর্ব। তার আগে সূর্যোদয়ের পর থেকেই চলে তাদের ধানক্ষেত অভিযান। ডেরার নাগরদের সঙ্গে কারও কারও খ-িত রোমান্টিকতাও জমে ওঠে। পুরোপুরি জমেছে বা পরিপূর্ণতা পেয়েছে, এমন ঘটনা আঙুলে গোনা।
চোখে দেখা ধানক্ষেত জীবনের রোমান্টিকতা ও বিষাদ পর্য এখনও মূর্ত। একদা নিউইয়র্কে বসে এ নিয়ে সনেট লিখেছিলাম। শিরোনাম ‘ধানকন্যা’। একাধিক সন্বিষ্ঠ পাঠকের অনুরোধ আমি যেন এ বিষয়ে একটি উপন্যাস লিখি। লিখতেও চেয়েছি। তবে আপাতত কবিতাটিই পড়ে নেয়া যাক।