Print

কবির ক্ষমতায়ন

আমার এখন ঘুম ধরেছে কি ধরেনি তা

পরখের জন্যে কিছু নিরপেক্ষ আলোর প্রয়োজন।

দিনের তীব্রতা কিংবা রাত দেয়ালের লাঠিবাতি

তরবারি আলোর ভেতর ঘুমের পারদ

নিচের দাগঘরে নেমে থাকতেই পারে।

এভাবে নিদ্রামাপার থার্মোমিটার

                কি আর সত্যতা-দেবে?

 

আমাদের সমাজ এখন শান্তিতে নিদ্রার, বাঁচবার

হাসবার, দাঁড়াবার সুদীর্ঘ নিরাপত্তা পেয়েছে কি-না

      তা জানতে পারবো সেই নির্বাচনী বর্ষে।

নিরপেক্ষ ঋতু বলে আমরা যে লগ্ন সাজিয়েছি

ভোটের বাসর, ধরে নাও সেই মধুচন্দ্রিমায়

                বসে এই কবিতা ফলাচ্ছি।

 

আমি এখন লিখবো নাকি মশারি টাঙাবো?

আগামীকাল অথবা পরশুতে কি

আমার কবিতাশ্রম বিষয়ে কোনো সেমিনার হবে?

প্রিয়জন আর অপ্রিয়জনকে বই বোঝানোর

কোনো আনুষ্ঠানিকতা না থাকলে,

মন্ত্রিসভার শপথে কোনো কাব্যপ্রতিনিধি না জড়ালে,

আন্দোলন-নির্বাচনের সকল শ্লোগান থেকে

তুলে নেওয়া হোক প্রান্তমিলের পংক্তি।

 

প্রকৃতি প্রধান কবিতার সবজি চাষ ঢের হলো।

কৃষিকবিদের চাষীলেখকের তাবৎ ফসল

ভরিয়েছে নান্দনিক সৌন্দর্যের আদি-অনাদির গোলা।

                                 গিলেছে মানুষ গলাভরে।

 

শিশুদের মুখে এতো মিষ্টি কবিতার পুষ্টি, ছড়াফল

কচি পৃথিবীর দ্বন্দ্ব দাবানো ছন্দের হাতধরা বিশাল বিকাশ

এতো সুবিধাভোগ তবে মিটালে না দায়।

 

অক্ষরের যোদ্ধাদের কোনো আন্দোলন-তেভাগা ছিলো না, শুধু অকপট অন্ধকার থেকে গেলো। পাঠকের কল্যাণে লেখক আর উভয়ের স্বার্থে স্বার্থসেবী প্রকাশক। তিন সেতুবন্ধ শ্রেণীর ভেতর মুনাফার আদাজল কে বেশি খেলেন, কে আবার গড়বেন ভবিতব্য?

শব্দশ্রমিকের পারিশ্রমিক, বোনাস, দাবির আগল  সবকিছু সুউচ্চ টুইন টাওয়ারের আদলে মুখ থুবড়ে মাটিতে ঠুকছে। মিশে যাচ্ছে মার্কস-এর শ্রমঘন্টার তথ্য, এ্যাঙ্গেলস্-এর বোনাস বিপ্লব। সেখানে সাহিত্যশিল্প পুঁজিরোগী আদমজীর হাত ধরে খুলেছে ই-মেইল অ্যাড্রেস  গুডবাই ডটকম। যেখানে হাতের পাঁচ পাঁচজন পুঁজিমুখো গদ্যকবির শাসনবিহার, সেখানে সহস্র হাতপাকা শব্দকর্মী, লক্ষাধিক কবি কারিগর, নিযুত কোটির সাহিত্য-স্বজন সবার ভেতরে দেখি দ্বিধার মিনার।

 

কবিরাই স্বপ্ন আর সভ্যতার পাঠে সতত অগ্রণী। নাকের ডগায় দেখো  উন্নাসিকতার আকাশ নামায়। দেহফোটা সংস্কৃতির রঙিন মশক। পাশেই রাজনীতির তিনমুখো আলো। সাদাকালো দিনরাত এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের আবছায়া তৃতীয় ফোরাম। বাজার উচ্ছন্নে তাই দ্বিধাগ্রস্ত কলম-কবি লিখবে, নাকি মশারি টাঙাবে?

 

হাসপাতালের শাহবাগ থেকে ক্ষীণকায় প্রত্যাশা কিনে আনা প্রতিভাপুরুষ আরেকটি ‘ক্লিন হার্ট’ অপারেশন চায়। মানুষের মনের অলিন্দে দেখো দলবাজির, দম্ভরশ্মি, ইউট্রাসে অপবিনোদন জ্বর, পাকস্থলিতে কাঁদে সশস্ত্র পাথর, লিভারে পচন ধরা সিনে-নেগেটিভ, হিমোগ্লোবিনের শিরাগুলো নেশার  নরক।

 

দেখুন সার্জন, কবিতার পুষ্টি না খেয়ে মানুষ বায়বীয় নৃত্য ও নূপুর খেয়েছে। এখন নগর খেয়ে ছিন্নভিন্ন করে মেঠো বসবাস।

 

কবিতার সাম্রাজ্য তাই আকাক্সক্ষার অলিন্দে

                আজকাল আন্দোলন তোলে।

কি করে পরখ হবে মানুষের মনের সড়কে

আলোবাতিময় তৃষিত ট্র্যাফিক হচ্ছে কবিতার বাঁশি?

সংস্কারের সংগ্রামী অ্যালোপ্যাথি ছাড়া

আগামীর হলমার্ক  সৃজনশীলতার পাঠ ছাড়া

                মুক্তবুদ্ধির বিজ্ঞান ছাড়া

                থমকে দাঁড়ায় দম, পায়ের কদম।

 

কবিতা ঘুমাবে কী না? বাতি জ্বললেই আর নিভলেই সুপারিশ হতে পারে। প্রভাবিত হতে পারে, সিদ্ধান্ত হবে না। ভাষা আর গীতি, গীতল গোয়াল থেকে, সিক্ত হলো মুক্তিময় মুখরতায়। পদ্যপ্রবণ গাভীর দুধে-ছন্দে, লেহনে গদ্যের পা নাড়ে সৃষ্টির প্রজন্ম। হাম্বা থেকে হাই, হ্যালো, ভাষাকে চরালো দেশশাবক কবি, কিন্তু ক্রমাগত শাসক হলো না। শিল্পকর্মের সাগর থেকে খানিক সৈকত নিয়ে, আবহমান নৃত্যের নূপুরটুকু নিয়ে উপমহাদেশীয় সুরের মাধ্যাকর্ষণ সুখ-সঙ্গীতের শ্বাসটুকু নিয়ে, তেভাগার তুমুল আন্দোলনের ফসল ব্যর্থতা নিয়ে, মুখর মুক্তিযুদ্ধের বাড়ন্ত দম্ভ নিয়ে, শায়েস্তা খাঁয়ের বাজার অর্থনীতির স্মৃতিমেঘ নিয়ে, বৃহত্তর কুমিল্লার পুতুল নাচের রাজনীতি নিয়ে, বিশ্বব্যাংক, পুঁজিবাঘের সাদাছড়ি নিরাপত্তা নিয়ে একটি মানবঘন দেশ এলোমেলো অন্ধত্বে এগুতে পারে, ঋদ্ধ সুশীল সমাজ এভাবে পারে না।

 

সমান্তরাল বিতর্ক-রেলে আস্তিক নাস্তিক নয়,

তাত্ত্বিক কথারা চায় ডিমফোটা সাফল্য বিপ্লব।

কবিতাও উম চায়, ফুটতে চায় ভরা ভূখন্ডের

                                সমগ্র কুসুমে,

একযোগে অপচেতনার অপযাতনার পর্দা না ফাটালে

সামান্য মুরগি দৌঁড়, শেয়াল যন্ত্রণাঘেরা

করুণামঞ্চের কুকরু কু উক্, কুকরু কু উক্

কবিতার এমন নাপিতগমন, অবদমন যেন

                চুল ফেলা ন্যাড়া চিকিৎসক

সমাজকে চিকিৎসা দেওয়ার আগে হয়ে ওঠে হাসির খোরাক।

 

যে কবি দর্শনে সিদ্ধ,

পৃথিবীর প্রাথমিকে যার প্রতিশ্রুতি ছিলো

                একটি সাজসমাজ আঁকবার,

প্রাগৈতিহাসিক সেই ইন্টেরিয়র ডিজাইনার,

আবেগের মাথামোটা সুদৃশ্য কুড়া ঈগল

ঘন ঘন অভিমানে যায়।

হঠাৎ বিমুখ হয়ে বিপরীত বাসর সাজায়।

অথচ ভূখন্ড দেখো, কবিতার দেশ সে তো নেই

                কাব্যের কলিজা রঙে, মেলোডি ছন্দের থরে থরে,

                উত্থিত উপমা নেই উদ্ভাসিত অহংকারে...

                স্বপ্নদের আত্মহত্যা দেখো

                ‘স্মৃতিদের সহমরণ সখ্য দেখো

না সাজা শহর দেখো কাঁচা বাজারের খোলস পরেছে।

যেমন জনতা গুণফলে, ততো তার মতামত

স্নিগ্ধ সেমিনার, গোলভোজন বৈঠকের বাহুল্য,

এতো যে কাগজ, মুখবন্ধ, টিভিটক, বৃক্ষরক্ষা কাভারেজ

কিন্তু কবিতারক্ষা সমিতি কোথায়?

দেশরক্ষার রক্ষী চেতনার রক্ষক যে শব্দশিল্প,

দেশদীক্ষার সু-অক্ষর মেলাবার যে দীপ্র কামার-কুমোর,

দেশগর্বের বাক্যছন্দ বিবরণে সবাক যে কবিয়াল,

দেশগীতির দোয়েলকণ্ঠে বাণী ধরা যে বাউল পথপাখি

দেশমেলার পার্বণে পার্বণে মজমা মাতানো হাটকবি

মাঠকবি, নৌকো নদী চরে নিরুদ্দেশ ঘাটকবি,

তৃণমূল থেকে সুউচ্চের ক্ষেতকাটা পাটকবি,

সাপধরা বিয়েপড়া, বানমারা মন্ত্রপাঠকবি

পয়ারে শ্মশানে দেহত্যাগে কফিনের খাটকবি,

কলেজে সদ্যবিকাশ ধরা ঠাঁটকবি,

প্রেমের আলোয় জ্বলা মোমবাতি-ছাঁটকবি,

অথবা বিরস গদ্যে, অমিত্রাক্ষরের কাঠকবি

দশকের ধারাপাতে অনিরুদ্ধ আশি, সত্তর বা ষাট কবি,

ঈঙ্গ-মার্কিনে মুখ্য বড়োলাট কবি

তদুর্ধ্ব বিষয় হলো ব্যবস্থাপনার সুকৌশলে চলা

অতি প্রকাশিত রাজন্য ভাঁজের ডাঁটকবি...

 

আরো আছে সতী কবি

মৌলিক, মডার্ন, পোস্টমডার্নের স্বপ্নচারী

আমিই রাজাধিরাজ  অধিপতি কবি!

সে যাক, রাজ্যটি ভালো কল্প কবিদের। তবে স্বপ্নটিতে

কিছু মুক্তির জোয়াল এনে

কলুর বলদ কবিতাকে দিতে হবে ট্রাক্টর সেচের স¦াদ।

জাবর কাটার গরুসঙ্গ থেকে

স্বাস্থ্যহানির অ্যালকোহলিক বাসী পান্তার গোগ্রাস থেকে

অসেদ্ধ পেঁয়াজ গন্ধ থেকে, রোগাটে বলদ পরিবার থেকে

কৃষির কবিরা খুঁজে নিক কম্পিউটারের চাষমুক্তি,

বিশ্বকোষ ব্রাউজিং,

মাউসের আঙুলে চাখুক বিশ্বকাব্যমঞ্চের মাতম।

চোখের দেখায় যে মাতৃভাষা গড়ালো গর্বে,

তার সমুদ্রজলের কাব্যস্রোত জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে

একবিশ্বদেশ নিয়ে আগামী গড়–ক।

কবিরা সহজে পারে, রাষ্ট্র তা পারে না।

কাঠামোর এতো সিঁড়ি, এতো হাতকড়া,

কবির বোরাক মন রকেটের ধাওয়াও মানে না।

কবির ক্ষমতা-গুণ, অবিরল অক্ষমতা

কবিসব জেনেও জানে না।